নিউজবাংলা ডেস্ক : কর্মসূত্রে সুদূর আন্দামানে গিয়ে পড়শি যুবকের সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, এরপর বাড়ি ফিরে প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন, তারই মাঝে স্বামীর সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলা। আর এই জটিল সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরেই শেষ পর্যন্ত স্বামীর হাতে নৃশংস ভাবে খুন হলেন ময়নার বাকচা গ্রাম পঞ্চায়েতের আড়ংকিয়ারানা গ্রামের গৃহবধূ শেফালি বর্মণ (৩৮)।
ইতিমধ্যে মহিলার মৃতদেহ সনাক্ত হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে কাটা মুন্ডু। গ্রেফতার হয়েছে খুনের ঘটনার মূল অভিযুক্ত শেফালির স্বামী পবিত্র বর্মনও। তবে কোন (Moyna Murder Case 🙂 আক্রোশে শেফালিকে খুন করে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল, রাতের অন্ধকারে কেনই বা দেহ লোপাট করে দেওয়ার চেষ্টা হল, সেই ঘটনার অন্তরতদন্তে নেমে আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে উঠে এসেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
প্রসঙ্গতঃ গত ২০ জানুয়ারি রবিবার বেলার দিকে পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না থানার দক্ষিণ আড়ংকিয়ারানা গ্রামের বিল্বতলা চন্ডিয়া নদীর তীর থেকে মহিলার অর্ধনগ্ন মুন্ডুহীন মৃতদেহ উদ্ধার হয়। তবে কাটা মাথার কোনও সন্ধান পাওয়া যায় নি। মহিলার পরিচয় উদ্ধার করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। দ্রোণ ক্যামেরা, পুলিশ কুকুর নিয়ে যৌথ ভাবে তদন্ত চালায় চন্ডীয়া নদীর ওপারে থাকা পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং ও এপারেরর ময়না থানার পুলিশ। অবশেষে ঘটনার ৫ দিনের মাথায় মৃত মহিলার পরিচয় জানা যায়।
শেফালির এই করুণ পরিণতির নেপথ্যে থাকা ঘটনার সূত্রপাত প্রায় বছর দুই আগে সুদূর আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। সেই সময় স্বামী পবিত্রর সঙ্গে জাহাজে চড়ে আন্দামানে পাড়ি দেয় শেফালি। সেখানে ভাড়া বাড়িতে থাকা কালীনই পাশের ঘরে থাকা যুবক শ্রীমন্ত মন্ডলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে যায় শেফালি। ওই যুবকের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের বুড়াবুড়ি এলাকায়। স্বামীর অজ্ঞাতে ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হয় পরকীয়া সম্পর্ক। এই ঘটনা জানার পর শেফালীর ওপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে পবিত্র। চাপে পড়ে শেফালির প্রেমিক আন্দামান ছেড়ে ভগবানপুরে ফিরে আসে। তবে অত্যাচারের পরেও স্বামীর সঙ্গ ছেড়ে আসার সাহস পায়নি শেফালি।
এর কারন হল শেফালির এক দাদা পবিত্রর কাছ থেকে প্রায় ২ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিল। এরই মাঝে স্বামীর অত্যাচারের মাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে প্রেমিকের সঙ্গেই ঘর বাঁধার সিদ্ধান্ত নেয় শেফালি। সেই মতোই প্রায় আড়াই মাস আগে আন্দামান থেকে ফিরে প্রথমে পশ্চিম মেদিনীপুরের দুবরাজপুরে বাপের বাড়িতে চলে যায় ওই গৃহবধূ। তারপর ভগবানপুরে প্রেমিকের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। পবিত্রকে ডিভোর্স দিয়ে শেফালি নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ নেয়। যদিও আইনের গেরোয় এই বিয়ে সম্ভব হয়নি। শেফালির প্রেমিক শ্রীমন্ত মন্ডল জানান, “ডিভোর্স ফাইল করার পর কমপক্ষ্যে ৬ মাস অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। তাই বিয়ে না করেই শেফালি আমার বাড়িতে থাকতে শুরু করে। প্রায় আড়াই মাস ধরে এভাবেই কাটছিল”।
তবে এরই ফাঁকে শেফালির স্বামী পবিত্র আন্দামান থেকে বাড়ি ফিরে আসে। এসেই মোবাইলে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। শেফালীর দাদা যে টাকা ধার নিয়েছে তা পরিশোধ করার জন্য চাপ দেয়। আর তা না দিলে শেফালীর দাদা ও তার ছেলেকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয় পবিত্র। সেই চাপে পড়েই পবিত্রর ডাকে সাড়া দিয়ে গত ১২ জানুয়ারী সন্ধ্যে নাগাদ কাউকে কিছু না জানিয়ে পবিত্রর কাছে চলে যায় শেফালি। সেখানে গিয়ে শেফালির ফোন স্যুইচ অফ হয়ে যায়। এরপর থেকে আর শেফালিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ বাদে গত ১৯ জানুয়ারী সকালে ময়নার দক্ষিণ আড়ংকিয়ারানা গ্রামের বিল্বতলা চন্ডিয়া নদীর তীর থেকে শেফালির অর্ধনগ্ন মৃতদেহ উদ্ধার হয়। তবে প্রথম দিকে কেউই শেফালিকে চিনতে পারেননি। শ্রীমন্ত জানিয়েছে, “ময়না থাকা থেকে আমাকেও ফোন করে মৃতদেহ সনাক্ত করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু জলে দীর্ঘক্ষণ থাকায় প্রথমে মৃতদেহ চিনতে পারিনি। পরে বৃহস্পতিবার পবিত্র ধরা পড়ার পর আমরা সমস্ত ঘটনা জানতে পারি”। শ্রীমন্ত জানিয়েছে, “শেফালিকে ভয় দেখিয়েই ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। তার যে এমন পরিণতি হবে তা আমরা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারিনি”।
অন্যদিকে শেফালীর বৌদি পশ্চিম মেদিনীপুরের দুবরাজপুরের বাসিন্দা অপর্ণা বর্মণ জানান, “নতুন স্বামীর ঘরে যাওয়ার পরেও পুরানো স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। ভাইফোঁটার সময় শেষবার বাপের বাড়িতে এসেছিল। ওর স্বামীর কাছ থেকে আমার ভাসুর ২ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিল। ৫০ হাজার টাকা কাজ করে পরিশোধ করে দিয়েছিল। এই নিয়ে পবিত্র প্রায়শই স্ত্রীকে মারধর করত। এই নিয়ে আগেও একাধিকবার গ্রামে সালিশি হয়েছে। শেফালি ফোনে বলেছিল, বাপের বাড়িকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে আমার প্রাণ দিতেও রাজি আছি। সেটাই যে ঘটবে আমরা ভাবতে পারিনি”। শেফালীর মা সীতা বর্মণ জানান, “মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার দিন কয়েক বাদে আমরা খবর পেয়েছিলাম। এখন শুনলাম তাঁকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে। যে এই কান্ড ঘটিয়েছে আমরা তার ফাঁসির দাবী জানাচ্ছি”।